চৌবাড়ীর ঠাকুর

বিরেশ্বরন্যায়ালঙ্কার ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র রামেশ্বরবিদ্যাবাচস্পতি ও তাঁহার ধারার পরিচয়।

ইঁহারা চৌবাড়ীর ঠাকুর বলিয়া অভিহিত


  1. রামেশ্বর বিদ্যাবাচস্পতি

  2. বীরেশ্বরের ৪র্থ পুত্র। ইনি ভাটপাড়া গ্রামের উত্তরাংশে পিতা ন্যায়ালঙ্কার ঠাকুরের বাগান জমিতে আসিয়া বাস করেন। ইঁহার অবর্ত্তমানে ইঁহার চার পুত্র স্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র ভাবে চার বাড়ী নির্ম্মাণ করতঃ বাস করেন বলিয়া “চৌবাড়ী” এই আখ্যা উদ্ভূত হয় এবং আজও পর্য্যন্ত তদ্বংশীয়েরা চৌবাড়ীর ঠাকুর বলিয়া অভিহিত হইয়া আসিতেছন। রামেশ্বর ঠাকুর পিতার উপযুক্ত পুত্র। তাঁহার জ্যেষ্ঠ রামগোপালের পর তিনিই ভাটপাড়ার দ্বিতীয় নৈয়ায়িক। তদুপরি ধর্ম্মশাস্ত্রে ও তন্ত্রশাস্ত্রেও প্রগাঢ় অধিকার ছিল। ভট্টপল্লীর সন্নিহিত গরিফা গ্রামে ইঁহার চতুষ্পাঠী ছিল। গরিফা ভাটপাড়ার সন্নিহিত হইলেও অন্ততঃ দেড় ক্রোশ উত্তরে, কিন্তু তখনকার কালে লোকে এ দুরত্মকে এপাড়া-ওপাড়ার ন্যায় মনে করিত। রামেশ্বরও তাহাই মনে করিতেন ও প্রত্যহ তথায় অনায়াসে যাতায়াত করিয়া ছাত্রদিগকে অধ্যাপনা করাইতেন। তাহার ব্যবহৃত কাষ্ঠপাদুকা ও বষ্টি এখনও যাহা তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র কমলাকান্ত সিদ্ধান্তপঞ্চাননের বংশীয়গণের গৃহে সযত্নে রক্ষিত হইতেছে তাহা দেখিলে তাঁহার আকারও যে বিলক্ষণ সুদীর্ঘ ও বলিষ্ঠ ছিল তাহা অনুমিত হয়। আজীবন অধ্যাপনাকারী ও অসামান্য পণ্ডিত রামেশ্বর বিস্তৃত যশের সঙ্গে-সঙ্গে বহুতর শিষ্য ও ভূসম্পত্তি অর্জ্জন করিয়াছিলেন। এক সময়ে ইনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় ধর্ম্মশাস্ত্রের একটি জটিল ব্যবস্থার সুমীমাংসা করতঃ সভাস্থ সকল পণ্ডিতকে চমৎকৃত করিয়া দেন, রাজাও তাঁহার এই সুপরিচিত বীরেশ্বরন্যায়ালঙ্কারঠাকুরের পুত্রের বিদ্যাবত্তায় মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে ২৪ পরগণার অন্তর্গত বেনাচণ্ডীপুর গ্রামে এক শত বিঘা ভূমি ব্রহ্মত্রারূপে দান করেন। এ জমি এখন তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রের ধারায় ভোগ হইতেছে। ইনি একটি শিবমন্দির ও একটি তুলসীমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন, শিবমন্দিরটি এখন আর নাই। ভাটপাড়ার পুর্ব্বাংশে পথিক সাধারণ ও গবাদি পশুগণের তৃষ্ণা নিবারণার্থে ইনি একটি বৃহৎ পুষ্করণী খনন ও প্রতিষ্ঠা করাইয়া যান। পুকুরটি এখন আর সম্পূর্ণ আকারে নাই কিয়দাংশ মাত্র আছে ও উহা নূতন পুকুর নামে অভিহিত। ঐ তুলসীমঞ্চ ও পুকুর এখন তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রের ধারার অধিকারে রহিয়াছে।
  3. জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন

  4. রামেশ্বর বাচস্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি তর্কশাস্ত্রে বাস্তবিকই পঞ্চানন অর্থাৎ সিংহের মতনই ছিলেন। তিনি অনেক সভা জয় করিয়াছিলেন। মহিষাদলের পুণ্যশীলা রাণী জানকী দেবী ইঁহার পাণ্ডিত্য ও তৎসহিত সদাচারে আবৃষ্টা হইয়া ইঁহাকে উপগুরুরূপে বরণ করেন ও এই ভাটপাড়া গ্রামেই তাঁহার অধিকারভুক্ত কয়েক বিঘা ভূমি নিষ্কর ব্রহ্মত্রারূপে দান করেন। তর্কপঞ্চাননের অর্থভাগ্যও প্রবল ছিল, তিনি তাঁহার মাতৃশ্রাদ্ধে “দম্পতি বরণ” নামক প্রভূত ব্যয়সাধ্য শ্রাদ্ধ করেন ও তাহাতে দেশের তাৎকালিক যাবতীয় পণ্ডিত ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হন। তিনি এত তেজস্বী ছিলেন যে ত্রিবেণীর সুপ্রসিদ্ধ জজপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন চাকুরি গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ঐ শ্রাদ্ধে আহ্বান করেন নাই। কিন্তু জজপণ্ডিত জগন্নাথ স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া ঠাকুর জগন্নাথের বাটীতে আগমন করেন ও পরম আপ্যায়িত হইয়া চলিয়া যান। ইনি দোরো পরগণায় প্রচুর ভূসম্পত্তি অর্জন করেন যাহা আজিও জগন্নাথ চক্ নামে অভিহিত হইয়া আসিতেছে। দুঃখের বিষয় ঐ সম্পত্তি এখন আর চৌবাড়ীর ধারায় কাহারও অধিকারে নাই। তিনি অর্থে ও পাণ্ডিত্যে ভাগ্যবান্‌ থাকিলেও পুত্রসম্পদে ভাগ্যহীন ছিলেন। তাঁহার জীবিত কালেই তাঁহার একমাত্র পুত্র ও পৌত্র অকালে কালগ্রাসে পতিত হন ও তাহার পর তিনি নিজে স্বর্গ গমন করিলে তাঁহার অবিরা পত্নী ও পৌত্রবধূর নিকট হইতে ঐ জগন্নাথ চক্ হস্তান্তরিত হইয়া যায়। তবে উহা এই বাশিষ্ঠ গৃহেই ভোগ হইতেছে। মহিষাদলের রাণীর নিকট হইতে প্রাপ্ত ভাটপাড়ার ভূসম্পত্তি চৌবাড়ীর ধারাতেই রহিয়াছে।
  5. রামকান্ত সার্ব্বভৌম

  6. রামেশ্বর বাচস্পতির ২য় পুত্র। বড় নৈয়ায়িক ছিলেন। অকালে ইঁহারও গঙ্গালাভ হওয়ায় ভট্টপল্লীসমাজ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। ইঁহারও ধারা নাই, কন্যা দৌহিত্রেই ইঁহার পর্যবসান।
  7. রামপ্রসাদ বিদ্যাপঞ্চানন

  8. ইনি রামেশ্বরের ৩য় পুত্র। অদ্বিতীয় তান্ত্রিক ও সাধক। এক সময়ে ইনি সাধনাবলে ভীষণ মনুষ্যভূক্ জলজন্তুপূর্ণ যশোর জেলার ইছামতী নদীতে নির্ভয়ে অবগাহন স্নান ও আকণ্ঠনিমজ্জিত অবস্থায় সন্ধ্যা-তর্পণাদি করিতে থাকেন। জলজন্তুরা সব তাঁহাকে দেখে আর দূরে দূরে সরিয়া যায়। এই আশ্চর্য্য ঘটনা লোক মুখে যশোহরের (প্রতাপাদিত্যের যশোর) তাৎকালিক রাজা শ্রীকন্ঠ রায় বাহাদুরের কর্ণে পৌঁছায়। রাঁজা বিস্মিত হইয়া তথায় আসেন ও স্বচক্ষে এই ব্যাপার দেখিয়া স্তম্ভিত হন। তিনি এত মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে ঠাকুর জলোত্তির্ণ হইলে তাঁহার পরিচয় লইয়া তাঁহার যথাবিধি আদর করেন। পরে তন্ত্রশাস্ত্রে তাঁহার অগাধ পাণ্ডিত্য দেখিয়া তাৎকালিক প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক পণ্ডিতদিগকে আহ্বান করিয়া এক সভা করেন ও তথায় পূর্ব্বে অমীমাংসিত এক প্রশ্নের সদুত্তর ঐ ঠাকুরের নিকট হইতে পাইয়া তাঁহার সম্মানস্বরূপ খুলনা জেলার বাদাকুল নামক মৌজা (আন্দাজ ৩০০০ বিঘা) দান করেন। ইহা এখন তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রের ধারায় ভুক্ত হইতেছে। শেষ জীবনে ইনি সংসার ত্যাগ করিয়া গঙ্গাতীরে কুটীর নির্ম্মাণ করতঃ তথায় বাস করেন। ইঁহার সাধ্বী পত্নী পরমেশ্বরী দেবী সহমৃতা হন।
  9. রঘূত্তম ঠাকুর

  10. রামপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিত গুণসম্পন্ন ছিলেন।
  11. শিবনাথ ঠাকুর

  12. রঘূত্তমের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিত গুণসম্পন্ন ছিলেন।
  13. প্রসন্নকুমার ঠাকুর

  14. শিবনাথের মধ্যম পুত্র। সঙ্গীতে অনুরাগ ছিল। বংশোচিত আচারবান্‌ ছিলেন।
  15. শশিশেখর ঠাকুর

  16. প্রসন্ন ঠাকুরের পুত্র। বড় শান্ত ও সরলস্বভাবের মনুষ্য ছিলেন। বংশোচিত আচার নিষ্ঠা ছিল।
  17. কৃষ্ণচন্দ্র তর্কভূষণ

  18. রামপ্রসাদের ২য় পুত্র। ন্যায়শাস্ত্রে সাক্ষাৎ গৌতম ছিলেন। বহু ছাত্র অধ্যাপনা করিয়াছেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই বংশেরই অন্যতম উজ্জলরত্ন ন্যায়শাস্ত্রে অপ্রতিদন্দ্বী পণ্ডিত গোবিন্দবিদ্যাবাগীশ ইঁহারই ছাত্র ছিলেন। ন্যায়শাস্ত্রের মত কাব্যালঙ্কারেও ইঁহার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ইনি কদম্বরীর এক টীকা রচনা করেন, ঐ টীকা বর্ত্তমান সকল টীকার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হইয়াছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় উহা এক গৃহদাহে নষ্ট হইয়া গিয়াছে।
  19. দেবনাথ ঠাকুর

  20. কৃষ্ণচন্দ্র তর্কভূষণের পৌত্র। জ্যোতিঃশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। জ্যোতিষ সম্বন্ধে অনেক নূতন তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইঁহার ধারা দৌহিত্রগত হইয়াছে।
  21. রামকিঙ্কর ন্যায়রত্ন

  22. রামপ্রসাদের ৩য় পুত্র। ইনি জ্যোতিষ ও তন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তাঁহার রচিত ও স্বহস্ত লিখিত জ্যোতীরহস্য গ্রন্থ বিদ্যার্থিগণের বিশেষ উপযোগী। ১২৫৯ সালে ইঁহার কাশীপ্রাপ্তি হয়।
  23. গোবিন্দদেব শিরোমণি

  24. রামকিঙ্করের পুত্র। ইনি তান্ত্রিক ও নিষ্ঠাবান্‌ ব্রাহ্মণ ছিলেন।
  25. চন্দ্রনাথ বিদ্যারত্ন

  26. গোবিন্দদেবের পুত্র। ইনি দেশপ্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক ছিলেন। বহু ছাত্র অন্নদানে অধ্যাপনা করিতেন। তাঁহার অধ্যাপনাগুণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য যেরূপ ছাত্র হউক না কোন তাঁহার নিকট পাঠে কৃতবিদ্য হইত। পণ্ডিতপ্রিয় হাতুয়ার রাজা ইঁহার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া ইঁহাকে বিশেষ সম্মান করিয়াছিলেন। ইঁহার প্রিয় মিষ্ট ভাষণে সকলেই মুগ্ধ হইত। ধর্ম্মপ্রাণ এই মহাপুরুষ তুলাপুরুষ দান ও দুর্গোৎসব প্রভৃতি বহু সৎকার্য্য করিয়া গিয়াছেন। ১৩০৯ সালে চৈত্র মাসে ৮২ বর্ষ বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়।
  27. রামকিশোর ন্যায়ভূষণ \normalsize{(রাশি নাম কৃপারাম)}

  28. রামেশ্বরবিদ্যাবাচস্পতির ৪র্থ পুত্র। ইনি একজন নামজাদা নৈয়ায়িক ও বক্তা ছিলেন। ইঁহার ধারায় যে সকল মহাপুরুষ বক্তৃতাশক্তি লইয়া জন্মিয়াছিলেন বলিয়া পরে বর্ণিত হইবে তাঁহাদের সেই শক্তি ইঁহারই রক্ত প্রবাহ হইতে সমুদ্ভূত। ইনি একজন বিশেষ বুদ্ধিমান্‌ ব্যক্তি ছিলেন।
  29. কাশীনাথ তর্কসিদ্ধান্ত \normalsize{(রাশি নাম জগদীশ)}

  30. রামকিশোর ন্যায়ভূষণের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি পিতার উপযুক্ত পুত্র যেন “প্রবর্ত্তিত দীপ ইব প্রদীপাৎ”। প্রধান নৈয়ায়িক ও সর্ব্বদা অধ্যাপনায় নিরত এই মহাপ্রাজ্ঞ পাঠ ও পাঠনাকেই জীবনের একমাত্র ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। সংসার তাঁহার নিকট আগ্রহের বিষয় ছিল না কনিষ্ঠ সহোদর মথুরানাথের হস্তে বিষয় আশয় শিষ্য সেবক সকল ভারই ন্যস্ত করিয়া নিজে যোগীর ন্যায় কেবল বিদ্যারই সাধনা করিতেন। লোকে তাঁহাকে সাগরের ন্যায় বিশাল জ্ঞানী বলিয়া সম্ভ্রমের চক্ষে দেখিত।
  31. রঘুনন্দন ন্যায়বাগীশ

  32. কাশীনাথ তর্কসিদ্ধান্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সুরূপ দীর্ঘাকার ও উত্তম বক্তা ছিলেন। তিনি তাঁহার বক্তৃতার মাধুর্য্যে গোবরডাঙ্গার জমিদার ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধর শ্রীশচন্দ্রের সভাতে বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। তাঁহারই চেষ্টায় ভাটপাড়ার সন্নিহিত কাঁটালপাড়া গ্রামের রাসমেলা প্রথম প্রবর্ত্তিত হয়। রাজা শ্রীশ্চন্দ্র ইঁহারই কথায় উহা প্রবর্ত্তিত করান।
  33. বৈকুন্ঠনাথ ঠাকুর

  34. রঘুনন্দন ন্যায়বাগীশের পুত্র। নিষ্ঠাবান্‌ সদাচারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। ইনি অপুত্রক থাকায় রঘুনন্দনের ধারা ইঁহা হইতেই অস্তমিত।
  35. আনন্দচন্দ্র শিরোমণি

  36. কাশীনাথ তর্কসিদ্ধান্তের মধ্যম পুত্র। তর্কসিদ্ধান্ত সাগর হইতে ইনি “আনন্দচন্দ্রশ্চন্দ্রোহসৌ” বলিয়া বিখ্যাত ছিলেন। কি মধুর সদালাপী পণ্ডিতই ছিলেন। বাগ্মিতা ও কবিত্ব একাধারে ইঁহাতে শোভিত ছিল। ইঁহার বাগ্মিতায় তাৎকালিক দেশের অনেক ধনী ইঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন। কবিত্বে ইনি প্রসিদ্ধ দাশরথি রায়কেও অতিক্রম করিয়াছিলেন। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক ইঁহার পাঁচালি সে সময়ে দেশে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হইয়াছিল। সংস্কৃতের সহিত বাঙ্গালায় কবিত্ব দেশে একটা নূতন ধারা আনিয়া দিয়াছিল। দুঃখের বিষয় শিরোমণি মহাশয়ের সেই অদ্ভুত পাঁচালি ও তৎসংক্রান্ত কৃষ্ণভক্তিসূচক অদ্ভুত অদ্ভুত সরল গান এখন মাত্র লোকমুখে কিছু কিছু শুনা যায় মূল গ্রন্থ নষ্ট হইয়া গিয়াছে উহা থাকিলে বঙ্গসাহিত্যভান্ডারে এক অপূর্ব্ব রত্ন থাকিয়া যাইত। অনন্যসাধারণ গুণে গুণবান্‌ এই মহাত্মার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া প্রসিদ্ধ প্রাণকৃষ্ণ হালদার প্রভৃতি গণ্যমান্য ধনী ইঁহার শিষ্য হন মহিষাদলের গুণগ্রাহী রাজা ইঁহাকে সম্পত্তি দিয়া সম্মানিত করেন। ইনি দীর্ঘাকার ও দীর্ঘজীবী ছিলেন। ১৮০২ শকে ৮৫ বর্ষ বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়।
  37. মধুসূদন স্মৃতিরত্ন

  38. আনন্দচন্দ্র শিরোমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি ভাটপাড়ার প্রধান স্মার্ত্ত অধ্যাপক ছিলেন। ইঁহারই ছাত্র পরম্পরায় আজ ভাটপাড়ায় স্মার্ত্তধারা রক্ষিত হইয়াছে। ইঁহার পাণ্ডিত্যে কেবল ভাটপাড়া নহে সমগ্র বঙ্গদেশ বিস্ফূরিত ছিল। ইনি বহু ছাত্রকে অন্ন দিয়া কৃতবিদ্য করিয়া গিয়াছেন। শাস্ত্রে ইঁহার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। জটিল ব্যবস্থাস্থলে তাঁহার ব্যবস্থা “ভাটপাড়ার মত” বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়া আসিতেছে। ইঁহার পাণ্ডিত্যে আকৃষ্ট হইয় পাঞ্জাব হাইকোর্টের ভূতপূর্ব্ব প্রধান বিচারপতি প্রতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইঁহার শিষ্য হন। এই প্রিয় মিষ্টভাষী পণ্ডিতবরেণ্য ১৮২১ শকে ৬৯ বর্ষ বয়সে গঙ্গালাভ করেন।
  39. হৃষিকেশ শাস্ত্রী

  40. মধুসূদন স্মৃতিরত্নের পুত্র। ইনি নানা শাস্ত্রে অধিকারী বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। এত উৎসাহী ছিলেন যে গোপনে লাহোরে গিয়া ইংরাজী পড়েন ও তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শাস্ত্রী পরীক্ষায় প্রশংসার সহিত প্রথম স্থান অধিকার করেন ও তথাকার ওরিএণ্টাল্‌ কলেজের প্রধান সংস্কৃতাধ্যাপক নিযুক্ত হন। সংস্কৃত সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবক এই মহাপ্রাজ্ঞ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে যে সংস্কৃত “বিদ্যোদয়” নামক মাসিক পত্রিকা বাহির করেন উহা তিনি তাঁহার শেষ জীবন পর্য্যন্ত অদম্য উৎসাহের সহিত চালাইয়া গিয়াছেন। ঐ পত্রিকা অধ্যাপক মোক্ষমুলার প্রভৃতি পণ্ডিতগণকর্ত্তৃক প্রশংসিত ছিল। তাঁহার সংস্কৃত গদ্যলিখন প্রণালী অতি মনোহর ছিল। পাঞ্জাব হইতে তিনি পিতামহ ও পিতার আদেশে বঙ্গদেশে আসেন ও কলিকাতা রাজকীয় সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি ইঁহার কীর্ত্তি ঘোষিত করিতেছে :– \begin{multicols}{2} \begin{enumerate} \item স্বকৃতটীকাসহ সুপদ্ম ব্যাকরণ। \item প্রাকৃত ব্যাকরণ। \item হিন্দী ব্যাকরণ। \item অর্থসংগ্রহের হিন্দী অনুবাদ। \item দত্তকচন্দ্রিকার হিন্দী অনুবাদ। \item মেঘদূতের বঙ্গানুবাদ। \item হ্যাম্লেটের সংস্কৃতানুবাদ। \item শাণ্ডিল্য-সূত্রের সভাষ্য বঙ্গানুবাদ। \item পাতঞ্জল যোগসূত্রের ব্যাখ্যা। \item এসিয়াটিক্‌ সোসাইটির সংস্কৃত পুস্তকের ক্যাটালগ। \item সংস্কৃত কলেজের সংস্কৃত পুস্তকের ক্যাটালগ। \end{enumerate} \end{multicols} সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সহিত বাড়ীতেও অন্ন দিয়া অনেক ছাত্র পড়াইয়া গিয়াছেন, ইঁহার ছাত্রের অনেকেই এখন মহামহোপাধ্যায় হইয়াছেন। এই সার ও মিতভাষী পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ ১৮৩৪ শকে ৬৪ বর্ষ বয়সে গঙ্গালাভ করেন। ইঁহার অভাবে কেবল ভাটপাড়ার নহে সমগ্রবঙ্গের বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে।
  41. যাদবচন্দ্র তর্করত্ন

  42. আনন্দচন্দ্র শিরোমণির কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি বিখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন, বহু ছাত্রকে স্বীয় চতুষ্পাঠীতে অন্ন দিয়া ন্যায়শাস্ত্র পড়াইতেন। মূর্ত্তি বড় সৌম্য ছিল। ইনি অপুত্রক হওয়ায় ইঁহার ধারা দৌহিত্রগত হইয়াছে।
  43. নীলমণি ন্যায়পঞ্চানন

  44. কাশীনাথ তর্কসিদ্ধান্তের কনিষ্ঠ পুত্র। তর্কসিদ্ধান্তসাগর হইতে ইনি “জাতো নীলমণির্মণিঃ” বলিয়া প্রশংসিত ছিলেন। এই ধর্ম্মভীরু নিষ্ঠাবান্‌ শান্তস্বভাব মহাপুরুষ শিষ্যগণের নিকট “শ্রীধর মূর্ত্তি” বলিয়া পূজিত হইতেন। লোভ কাহাকে বলে ইনি তাহা জানিতেন না। ভ্রাতৃগণের মত ইনিও বড় দীর্ঘাকার ও সুরূপ ছিলেন কিন্তু মধ্যায়ুঃ হইয়াছিলেন। ৫০ বর্ষ বয়সের মধ্যেই ইনি স্বর্গধামে চলিয়া যান।
  45. সূর্য্যকুমার ন্যায়রত্ন (রাশি নাম উমাচরণ)

  46. নীলমণি ন্যায়পঞ্চাননের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আবাল্য বিশুদ্ধচরিত্র শাস্ত্রবিশ্বাসী এই মহাপুরুষ সমগ্র ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। কিন্তু পড়াইবার সুযোগ পান নাই। ইঁহার পিতার যে নির্লোভতাগুণ উহা পূর্ণমাত্রায় ইঁহাতে বিকাশ পাইয়াছিল। অর্থে উপেক্ষা বুদ্ধিই ইঁহার জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। “মাচ যাচিস্ম কঞ্চন” ইহা তাঁহার জীবনের লক্ষ্য ছিল। ধারাগত বাগ্মিতার সহিত এমন একটা তেজস্বিতা ও নিষ্পৃহতা ছিল যে অর্থপ্রাণ সাধারণ মনুষ্যগণ তাঁহাকে বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। নির্লোভতার একটা পরিচয় দেই:– ইঁহার পত্নীর পিসী (ইঁহার পিস্শাশুড়ী), ইঁহারই এক বিশেষ অবস্থাপন্ন জ্ঞাতিভ্রাতার মাতা কোন এক সময়ে পুত্রের উপর ক্রোধ করিয়া তাঁহার নিজস্ব অন্যূন পাঁচ হাজার টাকার মণিমুক্তাখচিত সুবর্ণের কতকগুলি অলঙ্কার ভাইঝীর নিকট অতিগোপনে রাখিয়া দিয়া যান এবং বলিয়া যান যে, “এই সব অলঙ্কার তুই ব্যবহার করিস, আমি এ সব ছেলেদের দেব না”। যখন ইহা ঘটে এই মহাপ্রাণ তখন বাড়ী ছিলেন না। যেমন ধর্ম্মিষ্ঠ স্বামী, পত্নীও তদনুরূপ, স্বামী আসিলেই সব বৃত্তান্ত বলেন ও অলঙ্কারগুলি দেখান। এটা কম কথা নয়, পাঁচ হাজারের উপর টাকার জিনিষ তখনকার বাজারে জীবনের একটা বেশ অবলম্বন কিন্তু “যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ” – এই শাস্ত্র বাক্যের সাক্ষাৎ মূর্ত্তি সুর্য্যকুমার এই ব্যাপারে সাধারণের যাহা নিশা তাহা তাঁহার কাছে দিবা হইল ও দিবা নিশা হইল এবং তৎক্ষণাৎ তিনি একজন সংযমী মুনির ন্যায় সেই সমুদয় অলঙ্কার তাঁহার জ্ঞাতিভ্রাতার নিকট পৌঁছাইয়া দেন ও সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন। জ্ঞাতিভ্রাতা তাঁহার অপূর্ব্ব উচ্চ চরিত্রে বিস্মিত হইয়া ভক্তিগদ্গদচিত্তে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করেন। এই লোভজয়ী ব্রাহ্মণ বিশিষ্ট বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ-বংশীয় ধনিগণ সহবাসে চিরজীবন এইরূপ নিষ্পৃহ হইয়া অসঙ্কোচে কাল কাটাইয়া গিয়াছেন, তাঁহারাও এই নিষ্পৃহ মহাত্মাকে জ্যেষ্ঠের মত সমাদর করিতেন। শ্রীরামপুরের ও তেলিনীপাড়ার জমীদারগৃহে তিনি বিশেষরূপে আদৃত ছিলেন। নির্লোভভার গুণে ইনি প্রাচীনবয়সে লোভিগুরুত্যাগী খিদিরপুর ভূকৈলাস রাজবংশের একটি ধারার গুরুপদে বৃত হন। “প্রক্ষালনাদ্ধি পঙ্কস্য দূরাদস্পর্শনং বরং” অর্থসম্বন্ধে মহাভারতের এই মূল্যবান্‌ বচনটি তাঁহার মুখে সর্ব্বদাই শুনা যাইত। মনুষ্যজীবনের বিকাশ নানাভাবেই হইয়া থাকে, শাস্ত্রে সেই ভাবপ্রপঞ্চকে সত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়েরই অন্তর্গত করিয়া গিয়াছেন। রজোগুণ তন্মধ্যে সংসারের বড় উপযোগী। “রজঃ কর্ম্মণি ভারত”। রজঃ না থাকিলে সংসার চলিত না, সংসারের এই ঐশ্বর্য্য দেখিতে পাওয়া যাইত না। কথা সত্য, ব্যাপারও যথার্থ, তবুও কিন্তু সত্বগুণ বড় গুণ। “সত্বং সুখে সঞ্জয়তি”, সুখই জীবের একমাত্র প্রার্থনীয়। উহা পাওয়া যায় কিসে! রজোগুণে পাওয়া যায় না, কর্ম্মের যে সীমা নাই, উহা যে কেবল তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণ! সুখ পাওয়া যায় সত্বগুণে। লোভজয় সত্বগুণের বিবিধবিকাশের প্রধান বিকাশ। ইহা যে জীবে দেখা যায় সে জীব ধন্য। বুঝিতে হইবে তাহার গতি হইয়াছে সেই সুখময়ের দিকে। সূর্য্যকুমারের জীবনাবসানের বৃত্তান্তে সে গতি বেশ প্রস্ফুট হইয়াছে। ৮৩ বর্ষ বয়ঃক্রম বার্ধক্য ব্যতীত অন্য কোন পীড়া নাই। কয়েক দিন হইতে আহারে অপ্রবৃত্তি, জোর করিয়া খাওয়াইতে হইত, এইমাত্র উপসর্গ। এই অবস্থায় হঠাৎ পরিপক্ক ফলের স্বাভাবিক বৃন্তচ্যুতির মত তাঁহার দেহাবসান হয়। যেদিন উহা ঘটে সে দিন বাড়ীর লোক লক্ষ্য করিল তিনি যেন অনন্যমনে কাহাকে দেখিতছেন ও কাহার প্রতি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম করিতেছেন। আশ্চর্য্য! তাহার অল্পক্ষণ পরেই নিজের হাত নিজে দেখিয়া গঙ্গাযাত্রার সঙ্কেত করেন। তাঁহার পক্ষে সে কি শুভ মুহূর্ত্ত! গঙ্গার জল-স্থল, উত্তরায়ণ, মাঘ মাস, শুক্লপক্ষ, দিবাভাগ, সূর্য্য অস্তগমনোন্মুখ, আকাশের সূর্য্য যেন সঙ্গে করিয়া মর্ত্তের সুর্য্যকুমারকে স্বলোকে লইয়া গেলেন। এই মৃত্যুইতো জীবের বাঞ্ছনীয়, ইঁহারই নাম তো শুক্লা গতি, ইহাইতো অনাবৃত্তির দ্যোতক। যে চিরজীবন লোভজয়ী তাঁহার তো এমনি গতিই হওয়া উচিত। যোগ্যের যোগ্য পুরস্কারই ঘটিয়াছে। সন ১৩২০ সালে ইহা সঙ্ঘটিত হয়। শ্রীরামপুরের রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী ও তেলিনীপাড়ার জমীদার শ্রীযুত চন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার মৃত্যুতে জ্যেষ্ঠ-সহোদর বিয়োগ দুঃখ অনুভব করিয়াছিলেন। তাঁহার আদ্যশ্রাদ্ধে রাজা কিশোরী লাল গোস্বামী ভাটপাড়ায় শ্রাদ্ধস্থলে স্বয়ং উপস্থিত হইয়া ভাটপাড়া সমাজের সহিত তাঁহার আত্মার প্রতি সম্মান দেখাইয়া গিয়াছেন। এ আত্মা সম্মানের যোগ্য মহান্‌ আত্মাই ছিল।
  47. শ্রীনাথ তর্কালঙ্কার

  48. ইনি রামকিশোরের ২য় পুত্র। নিষ্ঠাবান্‌ সদাচারী সুব্রাহ্মণ ছিলেন।
  49. রামচন্দ্র ঠাকুর

  50. শ্রীনাথের কনিষ্ঠ পুত্র। একজন বিশিষ্ট তান্ত্রিক ও জাপক ছিলেন। স্বপাক ভিন্ন অন্নগ্রহণ করিতেন না।
  51. হেরম্বনাথ তত্বরত্ন

  52. রামচন্দ্র ঠাকুরের পুত্র। ইনি ইঁহার মধ্য বয়স হইতে একজন পরম ভাগবত ও ঔপনিষদিক হইয়াছিলেন। তখন হইতেই কাশীধামেই থাকিতেন ও তথায় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলিয়াই প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। কাশীধামেই ইঁহার দেহাবসান হয়।
  53. মথুরানাথ বিদ্যাসাগর

  54. রামকিশোরের কনিষ্ঠ পুত্র। ইনিও একজন উত্তম নৈয়ায়িক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ কাশীনাথের মত ইনিও বহু ছাত্র অধ্যাপনা করিতেন তবে জ্যোষ্ঠের অধ্যাপনায় তদ্গতচিত্ততা থাকায় বিষয়-আশয় শিষ্য-সেবক ইঁহাকেই রক্ষা করিতে হইত।
  55. বিশ্বম্ভর ঠাকুর

  56. মথুরানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বড় সদাশয় শিবতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। যৌবনে ইনি অনৈসর্গিক দেহবল প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
  57. ভগবতী ঠাকুর

  58. বিশ্বম্ভরের পুত্র। সংস্কৃতভাষায় ব্যুৎপন্ন, মিষ্টভাষী ও বড় বুদ্ধিমান্‌ ব্যক্তি ছিলেন। ইঁহার ধারা নাই।
  59. ক্ষেত্রমোহন ন্যায়রত্ন

  60. মথুরানাথের ২য় পুত্র। ইনি একজন অতি তেজস্বী নৈয়ায়িক ছিলেন। মাত্র ২৮ বৎসর বয়সে বড় অকালে এই প্রস্ফুটমান উজ্জ্বল মধুর গন্ধ বিকীরণকারী কুসুম কালচক্রের তীক্ষ্ণধারে বৃন্তচ্যুত হইয়া যায়। ভট্টপল্লীসমাজ সে সময়ে হায় হায় করিয়াছিল।
  61. যজ্ঞেশ্বর ন্যায়বাগীশ

  62. ক্ষেত্রমোহনের জোষ্ঠ পুত্র। ইনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন প্রগাঢ় ব্যুৎপন্ন বৈয়াকরণিক ছিলেন। কর্ম্মকাণ্ডে ইঁহার দক্ষতা অসাধারণ ছিল।
  63. নৃত্যগোপাল বিদ্যাভূষণ

  64. যজ্ঞেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি ইংরাজী অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। এবং উহাতে কৃতবিদ্য হইয়া বি.এ. উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। ইংরাজী শিক্ষিত হইলেও ইনি বংশোচিত আচার ও নিষ্ঠা যথাযথভাবে পালন করিতেন। সংস্কৃতে যথেষ্ট অনুরাগ ছিল এবং বিদ্যাভূষণ উপাধি এই জন্যেই এই সমাজ হইতে পাইয়া ছিলেন। বেশ বক্তৃতা করিতে পারিতেন। দশকর্ম্মে বিশেষ দক্ষতা ছিল। ইনি স্কুল সাব-ইন্সপেক্টরের পদ পাইয়াছিলেন। ইনিও বড় অকালে কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় সমাজ ক্ষীণরত্ন হইয়া গিয়াছে।
  65. নন্দগোপাল সরস্বতী

  66. যজ্ঞেশ্বরের ২য় পুত্র। ব্যাকরণ কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। গবর্ণমেণ্টের উপাধি পরীক্ষায় ইনি কাব্যতীর্থ ও ভট্টপল্লীসমাজ হইতে সরস্বতী উপাধি পাইয়াছিলেন। বড় প্রিয়দর্শন, সদাই হাস্যমুখ এই নবীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আপনার বিদ্যাবত্তায় আচার-অনুষ্ঠানে ভাগলপুরের বঙ্গীয় জনসমাজে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। সমাজের বড়ই দুর্ভাগ্য যে এ রত্নটিও অকালে চলিয়া গিয়াছে।
  67. ব্রজগোপাল ঠাকুর

  68. যজ্ঞেশ্বরের কনিষ্ঠ পুত্র। শান্ত সুশীল সুব্রাহ্মণ ছিলেন। এ ধারাটি বড় আল্পায়ুঃ ব্রজগোপালও এই কয়েক দিন হইল শিশু পুত্র-কন্যাগণকে অকূলে ভাসাইয়া চলিয়া গিয়াছে।
  69. মতিলাল ঠাকুর

  70. ক্ষেত্রমোহনের ২য় পুত্র। ধার্ম্মিক সরলচিত্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন। মৃত্যুও ইঁহার অদ্ভূত হইয়াছিল। সজ্ঞানে হরিনাম উচ্চারণ ও তুলসীগুচ্ছ মস্তকে আন্দোলন করিতে করিতে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। ইঁহার বংশ নাই।
  71. হরিমোহন বিদ্যারত্ন

  72. মথুরানাথের কনিষ্ঠ পুত্র। ভারি সুরসিক ও ব্যয়গুণ্ডীর ছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ দক্ষতা থাকায় ইনি বেতিয়া রাজার সভাপণ্ডিত হইয়া তথায় বড় সম্মানের সহ্তি কাল কাটাইয়া ছিলেন। শেষ বয়সে কাশীবাসী হন ও কাশীতেই মহাপ্রয়াণ করেন। ইঁহার ধারা নাই।
  73. কমলাকান্ত সিদ্ধান্তপঞ্চানন

  74. রামেশ্বর বিদ্যাবাচস্পতির কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি পিতার জীবনান্তে গরিফা গ্রামে পিতার চতুষ্পাঠীতেই অধ্যাপনা করিতেন। ইনি অত্যন্ত শাস্ত্রবিশ্বাসী ও শান্তস্বভাব ব্যক্তি ছিলেন। ইঁহার ভক্তিতে পিতা রামেশ্বর ঠাকুর প্রাচীন অবস্থায় ইঁহার সংসারেই অবস্থান করিয়াছিলেন। ইঁহার দেহান্ত হইলে ইঁহার সাধ্বী পত্নী তারিনী দেবী সহমৃতা হন। সে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য! শুনা যায় যে দিন ইহা ঘটে সে দিন বিজয়া দশমী। স্বামীর জন্য যিনি এককালে দেহ বিসর্জন দিয়াছিলেন সেই সতীস্বরূপিনী পার্ব্বতী আজ মৃন্ময়ী মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া হিমালয়ে চলিয়া যাইতেছেন আর সেই সঙ্গে তাঁহারই মানবী মূর্ত্তি তারিণী মৃত পতিকে বক্ষে লইয়া হাস্যবদনে চিতারোহণ করিতেছেন। কি মিলন! সতীতে সতীতে কি মিলন! দর্শকগণ কৃতার্থ হইয়াছিল। আত্মত্যাগই যে প্রধান ধর্ম্ম এই বংশের ঐ পবিত্রা রমণী তাহা দেখাইয়া গিয়াছেন। ধরা ধন্য হইয়াছে। ধন্য বংশধরেরা পতিব্রতার সেই শেষ পরিত্যক্ত পরিধেয় শাটীখানি অতিযত্নে রক্ষা করিতেছেন।
  75. শিবনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন

  76. কমলাকান্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি ন্যায়শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, তন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন, অত্যন্ত শান্তস্বভাব ও আচারবান্‌ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন।
  77. শ্রীধর বিদ্যারত্ন

  78. শিবনারায়ণের ৩য় পুত্র। একজন ঋষিকল্প প্রাতঃস্মরণীয় মহাত্মা ছিলেন। তন্ত্র, সংহিতা ও পুরাণাদিশাস্ত্রে তিনি গভীর জ্ঞান সঞ্চয় করিয়াছিলেন। এই পণ্ডিতবহুল ভট্টপল্লীতে তন্ত্রের দুর্ব্বোধ্য বিষয়ের কোন প্রশ্ন তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি উহা অনায়াসে সমাধান করিয়া দিতেন। সংহিতা ও পুরাণসমূহ তাঁহার জিহ্বাগ্রে ছিল। ৭ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হইয়া অভিভাবক শূন্যহইলেও বালককাল হইতেই গুরুর উচিত জ্ঞান, গাম্ভীর্য্য, সদাচার ও অসাধারণ আত্মনিষ্ঠায় ভট্টপল্লীর বশিষ্ঠবংশের মধ্যে একজন আদর্শ গুরু হইয়াছিলেন। শীত গ্রীষ্মাদি ঋতু নির্ব্বিশেষে ব্রাহ্মমুহূর্তে নিত্য প্রাতঃস্নান করিতেন। তিনি সময়ের বড় সদ্ব্যবহার করিতে ভালবাসিতেন বলিয়া সর্ব্বদা ঘড়ি ব্যবহার করিতেন ও উহা সূর্য্যের উদয়াস্তকালের সহিত মিলাইয়া তদনুসারে নিয়মিত সময়ে ত্রিসন্ধ্যা করিতেন। নিত্য পূজা প্রভৃতি বর্ণাশ্রমধর্ম্মোচিত কর্ত্তব্য তাঁহার জীবনের একটি ব্রত ছিল। ইঁহার অসাধারণ সদাচার ও ব্রহ্মর্ষি প্রতিমারূপ সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিত। এরূপ শাস্ত্রবিশ্বাসী ধর্ম্মানুরাগী, জ্ঞানী, সদাচারসম্পন্ন, অনুষ্ঠানান্বিত, সংযমী, নিয়মী, তেজস্বী অথচ শান্তস্বভাব পুরুষ অতি অল্পই দৃষ্টিগোচর হয়। একাধারে এতগুণ নিতান্ত দুর্লভ। অবতারভূত বাশিষ্ঠ মহাপুরুষ ৺নারায়ণঠাকুরের বংশেই এমন পুরুষের জন্ম সম্ভব হইয়াছিল। ইঁহার স্মরণেও পুণ্য হয়। কাল সকলকেই গ্রাস করে, ইঁহাকেও করিয়াছে। আবার এমন কি সুদিন আসিবে যে এহেন ব্রাহ্মণরত্ন এ বংশে দেখা দিবেন! সন ১৩১৭ শালে ৮৮ বৎসর বয়সে পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্র প্রভৃতি রাখিয়া মুক্তিখেত্র গঙ্গায় এই মহাপ্রাণ মহাপ্রয়াণ করিয়াছেন। ইঁহার পুণ্যবতী পত্নী নয়নতারাদেবী বৃদ্ধ প্রপৌত্রের মুখদর্শন করিয়াছিলেন যাহা সংসারীর পক্ষে একান্ত দুর্লভ। “নাতির নাতি স্বর্গে বাতি” এই চলতি কথার জীবন্ত উদাহরণ দেখাইয়া গিরাছেন। যতদূর অনুসন্ধানে জানা যায় তাহাতে এবংশে এরূপ সৌভাগ্য কাহারও অদৃষ্টে ঘটে নাই। সন ১৩২৯ সালে ৯৪ বর্ষ বয়সে সকল ইন্দ্রিয় অবিকৃত অবস্থায় ও দেহ আয়ত্তাধীনে রাখিয়া গঙ্গালাভ হয়।
  79. রামময় তর্করত্ন

  80. শ্রীধরবিদ্যারত্নের ২য় পুত্র। ইনি স্মৃতি ও জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ও ব্রাহ্মণোচিত সদ্গুণসমূহের আকর ছিলেন। নিজ চতুষ্পাঠীতে স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যাপনা করিতেন। বর্ত্তমান গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, যাহা বঙ্গীয় হিন্দুসাধারণের ধর্ম্মকর্ম্মের একমাত্র অবলম্বন ইনি তাহার প্রথম উদ্ভব হইতে সুদীর্ঘকাল যাবৎ অন্যতম প্রধান গণনাসংশোধক ও ধর্ম্মকর্ম্মের ব্যবস্থাপক হিসাবে প্রাণ স্বরূপ ছিলেন। ইঁহার পাণ্ডিত্যের ফলভাগী বঙ্গের হিন্দুসমাজ এ বিষয়ে তাঁহার নিকট বিশেষভাবে ঋণী। ১৩১৪ সালে ৬৩ বৎসর বয়ঃক্রমে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। ইঁহার অভাবে ভট্টপল্লীসমাজ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।
  81. ভুবনমোহন ঠাকুর

  82. রামময় তর্করত্নের কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি শান্ত-শিষ্ট আচারবান্‌ ও বাণিজ্যবুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন। অকালে ইঁহার দেহাবসান হয়।